রবিবার ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কতটা সুরক্ষিত হবে জনগণের অধিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ২৭ মে ২০২৩ | প্রিন্ট

কতটা সুরক্ষিত হবে জনগণের অধিকার

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে তোলপাড় চলছে রাজনীতি অঙ্গন থেকে সুশীল সমাজ সর্বত্র। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা দেখা করার পর থেকে এ বিষয়টি নিয়ে আরও জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু যে ভিসা নীতি নিয়ে এত আলাপ-সমালোচনা, তা কতটুকু সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নে কাজে আসবে তাই এখন বড় প্রশ্ন।

গত বুধবার বাংলাদেশকে উদ্দেশে করে ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করলে সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে জানিয়েছে দেশটি। এ ভিসা নীতি যে কোনো বাংলাদেশির ওপর কার্যকর হবে। তবে বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেই প্রতিশ্রুতিকে সহায়তা করতে এ ভিসা নীতির ঘোষণা বলেও জানিয়েছেন দেশটির মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারের পক্ষ থেকেও খুশি বা অখুশি না হয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সতর্কতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এর আগে নাইজেরিয়া ও সোমালিয়ার ওপরও একই ধরনের কারণ দেখিয়ে দেশগুলোর বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে তা করা হয়েছিল দেশগুলোর নির্বাচনের পর। তবে বাংলাদেশই বিশ্বের প্রথম দেশ, যাদের নির্বাচনের আগে এ ধরনের হুমকি দেওয়া হলো। এখন পর্যন্ত আফ্রিকার কয়েকটি দেশ বাদে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রের নজরে পড়েছে, যাদের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে এ ধরনের ঘোষণা দিতে হয়েছে দেশটিকে।তবে এ বিষয়টি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও সম্ভাবনাময় একটি দেশের জন্য কতটা সম্মানের তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাহলে বাংলাদেশে কি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় বলে মনে করে না যুক্তরাষ্ট্র? অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার সুরক্ষিত করতে কি রাষ্ট্রই যথেষ্ট নয়? প্রশ্ন তোলা যায়, দেশের রাজনীতিবিদরা কেন এ সংকটের সমাধান দিতে পারলেন না, যেখানে দেশের সব সংকটে মুখ্য ভূমিকা তাঁদের পালন করার কথা। তাহলে এ নিষেধাজ্ঞা কি দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে নাকি ভূরাজনৈতিক কোনো অভিপ্রায় ও কৌশলগত বিষয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, এ ভিসা নীতি জনগণের ভোটাধিকার কতটা সুনিশ্চিত করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এর মধ্যে দিয়ে নিজস্ব স্বার্থ ও কৌশল খুঁজছে। বড় দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে এ নিয়ে অস্বস্তি দেখা গেলেও বিএনপির জ্বালাও-পোড়াওকে সামনে নিয়ে এসেছে তারা। বিএনপি আগের মতো নির্বাচনে বাধা দিতে পারবে না বলেও দাবি করেছে সরকারি দলটি। তবে বিএনপির দাবি, সরকার আর ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করতে পারবে না। এমনকি পুলিশ ও প্রশাসন বিএনপির বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা-হামলায়ও অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু এর পরও প্রধান দুটি দলের কাছে জনগণ এক ধরনের উপেক্ষিতই থাকছে। তাদের মৌলিক অধিকারগুলো আড়ালেই থাকছে।

ভিসা নীতি অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে– এমন কাজগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা। এ কাজগুলোকে দেখলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।

তবে যুক্তরাষ্ট্র এও বলছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সবার। এসবের তালিকায় রয়েছে ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম। তার অর্থ সরকার তার পুলিশ প্রশাসন ব্যবহার করে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে মতামত প্রকাশ, ভোটাধিকার, ভোটারদের ভয় দেখানো বা রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিক সভা-সমাবেশে বাধা দিতে পারবে না। ঠিক একইভাবে বিরোধী দলও দাবি আদায়ের নামে জ্বালাও-পোড়াও করতে পারবে না।

সরকার যদি নির্বাচনে তার পক্ষে প্রশাসন ব্যবহার নাও করে, তার মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীরা যদি অতি উৎসাহী হয়ে অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে, তবে মার্কিন এ ভিসা নীতির ফলে জবাবদিহির আওতায় পড়তে হবে দায়িত্ব পালন করা নির্বাহীদের।

আবার বিএনপির একমাত্র দাবি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। তবে সংবিধানে যেহেতু বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান নেই, তাই এ দাবির পক্ষে কোনো দেশের সমর্থন নেই। আর এখন পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন করে এ রকম কোনো বিধান সংযুক্তির মনোভাব সরকারের দেখা যায়নি। আবার দাবি আদায়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ করতে পারলেও এমন কোনো কর্মসূচি নিতে পারবে না, যার ফলে এ ভিসা নীতির জবাবদিহির আওতায় তারা পড়ে যায়। তাহলে কি বিএনপি এ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাবে– এ প্রশ্নও চলে আসে।

এখন কোনো দলই যদি তাদের চিরচেনা কৌশল প্রয়োগ করতে না পারে, তবে তাদের কৌশল কি হবে? এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোই দিতে পারবে। তবে গণতান্ত্রিক ধারা অনুয়ায়ী কিছুটা হলেও সময় এসেছে জনগণের। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফেরত দেওয়ার সময় এসেছে। যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান দায়িত্ব ছিল জনগণের সংকট দূর করার। শেষ কথা হলো, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে অস্তিত্বের প্রয়োজনে দলগুলো ভিসা নীতি কতটা আমলে নেবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির সমকালকে বলেন, এ দেশে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু, কার্যকর নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আশা করি, নির্বাচনের অংশীজনরা যেমন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম– সবাই এটাকে গুরুত্ব দেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ ইতিবাচকভাবে নেওয়া হলে তা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। আর সেটা না মানলে দেশের ভেতরে যেমন সহিংসতার আশঙ্কা থেকে যায়, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে ও গণতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি, সেটাও হুমকির মুখে পড়বে।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৩:২০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৭ মে ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]