নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ১০ জুলাই ২০২৩ | প্রিন্ট
প্রতি বছর পরোক্ষ ধূমপানের কারণে প্রায় ৬ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শুধু তাই নয়, তামাকের ধোঁয়ায় রয়েছে ৭ হাজারটি রাসায়নিক পদার্থ, এর মধ্যে ৭০টি পদার্থ ক্যানসার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস, ক্যানসার, স্ট্রোক ও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ এর তথ্য মতে, ৪২.৭ শতাংশ (৮১ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কর্মক্ষেত্রে এবং প্রায় ৪৪ শতাংশ (২ কোটি ৫০ লাখ) মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। এছাড়াও রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন ৪৯.৭ শতাংশ মানুষ। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে।
বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার সুযোগ থাকায় পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় আইনটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। একই সঙ্গে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর ধারা ৮ ও এ সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে অধূমপায়ীদেরকে রক্ষায় ‘পূর্ণাঙ্গ ধুমপানমুক্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এফসিটিসির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ধূমপান শুধু যে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে তা নয়, এটি আর্থিক ক্ষতিরও অন্যতম কারণ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পরোক্ষ ধূমপানের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ মোট তামাক ব্যবহারজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কষ্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কষ্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ১শ কোটি টাকা।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ অনুযায়ী চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেস এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে মাত্র কয়েকটি স্থান (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, গ্রন্থাগার, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র ও থিয়েটার হলের অভ্যন্তরে, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ এক কক্ষবিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, শিশু পার্ক, খেলাধুলা ও অনুশীলনের জন্য নির্ধারিত আচ্ছাদিত স্থান এবং এক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহণ) ব্যতীত বেশিরভাগ পাবলিক প্লেস এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে (স্টিমার, লঞ্চ ইত্যাদি) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ‘ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন’ রয়েছে। ফলে অধূমপায়ীদের পাশাপাশি এসব স্থানে সেবা প্রদান করতে গিয়ে সেবাকর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এফসিটিসি আর্টিকেল ৮ এর গাইডলাইন এবং অসংখ্য গবেষণা দ্বারাও এটা স্বীকৃত যে, আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশেপাশের স্থানসমূহ কখনই ধোঁয়ামুক্ত হয় না।
বাংলাদেশেও তামাক ব্যবহারের চিত্র ভয়াবহ। বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২ কোটি ২০ লাখ (২০.৬%) এবং ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লাখ (১৮%)। বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কষ্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কষ্ট অ্যাপ্রোচ’শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, ধূমপায়ীদের হাত থেকে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয় এমন রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের হোটেল, পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র এবং একাধিক কামরা বিশিষ্ট যান্ত্রিক পরিবহণ ও সকল অ-যান্ত্রিক গণপরিবহনে ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ‘ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন’ বিলুপ্ত করার দাবি উঠে এসেছে। পাশাপাশি ধূমপানমুক্ত ভবন বলতে সেই ভবনের বারান্দাসহ সকল আচ্ছাদিত স্থানকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে চলতি সংসদেই যাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধন করা হয় এবং পাবলিক প্লেস যেন শতভাগ ধূমপানমুক্ত করা হয়, এমনটি দাবি দেশের সাধারণ মানুষের।
Posted ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১০ জুলাই ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin