নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ০৩ আগস্ট ২০২৩ | প্রিন্ট
মধ্যবিত্তের দুপুর গড়িয়ে হালকা ঝিমুনি দেওয়া শরীর পৌঁছে গেলো মিরপুর-১-এর সিনেপ্লেক্সে। চিত্তবিনোদনের একটু সুযোগ হাত ছাড়া করতে না চাওয়া আমি সময়ের বাঁক খুঁজতে গিয়ে দেখি, চার বছর পর সিনেমা দেখতে হলমুখী আমি। বাংলা সিনেমায় গল্পের দৈন্যদশার যে কালো মেঘ তৈরি হয়েছিলো, তা কিছুটা হলেও কমছে এমন খবর সকলের মুখে চাউর হওয়ায়, স্বচক্ষে নিরীক্ষণের জন্য আমার হলমুখী হওয়া। শুধু আমি নই, ঈদুল আজহায় মুক্তিপ্রাপ্ত পাঁচটি সিনেমা ঘিরে দর্শদের আগ্রহ ছিলো তুমুল। ঘনবর্ষণের মতো এতটা আগ্রহ অনেক বছর দেখা যায়নি।
প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ, প্রহেলিকা, লাল শাড়ি, এবং ক্যাসিনো’র গল্প ছিলো একদম ভিন্নধারার। যদি ভন্নিধারার না হতো তবে মানুষকে আকর্ষণ করতে পারতো না। পাঁচটি সিনেমা দেখার শখ থাকলেও পকেটের স্বাস্থ্য ভালো না হওয়ায়, সকলের সঙ্গে একপ্রকার অবিচার করে দেখলাম ‘সুড়ঙ্গ’। তার প্রধান কারণ ছিলো আফরান নিশো। ছোটপর্দায় নিজেকে দীর্ঘদিন ধরে ভাংচুর করে বড় পর্দায় এসেছেন। ৪০০টাকার বাজি তার উপর ধরে আরাম করে বসতেই অভিনয়ের ‘রাজকীয় এন্ট্রি’ দেখলাম।
সিনেমার ট্রেইলার দেখে বুঝা গিয়েছিলো, ২০১৪ সালের কিশোরগঞ্জের আলোচিত সুড়ঙ্গ খুড়ে ব্যাংক ডাকাতির গল্পের সঙ্গে অনেকটা মিল থাকবে। মূলতো এই গল্পকে কেন্দ্র করে সিনেমাটি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের সমাজের পরিচিত বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কও এই সিনেমাটিকে দীর্ঘতর করতে সহায়তা করেছে। তবে, বড় পর্দার রমরমা-গমগমা অনুভূতি এখানে পাওয়া যায়নি। খুব ছোট ছোট ফ্রেমে গুটিকয়েক চরিত্রের সিনেমা। আমার কাছে ‘সুরঙ্গ’কে টেলিফিল্মের চেয়ে একটু বেশি কিছু মনে হয়েছে। তার কারণ নুসরাত ফারিয়া। ‘কলিজা আর জান’ গানে এই অভিনেত্রীর পারফর্মে ছিলো দারুণ। আরাফাত মহসীন নিধির সুর-সংগীতে এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন কণা।
এই আইটেম গানে ফারিয়ার সঙ্গে প্রায় ৪০০ নৃত্যশিল্পী অংশ নিয়েছেন। গানটির জন্য পরিচালক রায়হান রাফী যতটা ব্যয় করেছেন ততোটা মনে হয়নি সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করতে খরচ করেছেন।
তবে এটাও সত্য বড় পর্দায় রাজকীয় অভিষেক হয়েছে আফরান নিশোর। এমন অভিষেক সিনেমাপ্রেমীরা সম্ভবত সালমান শাহের পর খুব একটা দেখেনি। দীর্ঘ অভিনয় দক্ষতার মান নিশো রেখেছেন। হলভতি দর্শকের করতালিও পেয়েছেন। নিজের প্রথম চরিত্র ‘মাসুদ’ সিগনেচার হয়ে থাকবে বলবো না তবে দর্শক অনেক দিন মনে রাখবে।
সিনেমার দ্বিতীয় চরিত্র অর্থলোভী ময়না। এই চরিত্রকে তমা মির্জা চাইলে আরো সূক্ষ্ম ভালো অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারতো বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। কিছুটা গাছা ছাড়া লেগেছে। অন্যদিকে মোস্তফা মন্ওয়ার।
‘না চাইলেও পাও দুইটা তোমার দিকেই হাঁটে,
না বাইলেও নাও ছুইটা ভিড়ে তোমার ঘাটে।
সব হইলো উলটাপালটা, আটকা মোরে তোরা,
দিল আমার লাগামছাড়া পাগলা ঘোড়া…’
‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় এই গানটি যেন মোস্তফা মন্ওয়ারের থিম সং হয়ে গেছে। বলছি জহির চরিত্রের কথা। পরিচালক রায়হান রাফীর অবাক করা সৃষ্টি এই জহির। সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় মাসুদের বন্ধু জহির যেন পারলে জীবন দিয়ে দেয়। তারপর সময় গড়াতে থাকে, জহিরের চরিত্রের নানা রঙও বের হয়ে আসতে থাকে। মাথা নিচু করে কথা বলা জহির চরিত্রটাকে এতটা সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন এই অভিনেতা, যা সকলকে মুগ্ধ করে ছেড়েছে।
আর একটি চরিত্রের কথা না বললেই নয়, প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা শহীদুজ্জামান সেলিম। তার স্বল্পক্ষণের উপস্থিতিতে হাস্যরসের যে ক্যামিও তৈরি হয়েছে তা এক কথায় দারুণ। তবে সিনেমা শেষের আগে অযথা গল্প টেনে বড় করা হইছে বলে মনে হয়েছে।
‘সুড়ঙ্গ’কে বাণিজ্যিক ফিল্মের রূপ দেয়ার চেষ্টা করেও মনে হয়েছে ব্যর্থ হয়েছেন পরিচালক। সিনেমার মেকিং-এ কোনো ক্যারিশমা পাইনি। এমন একটি দৃশ্য নাই যেটা মনে রাখা যায় অনেকদিন। তবু দর্শক গ্রহণ করেছে, আমার মতো শুধু মাত্র নিশো এবং তার অভিনয় দক্ষতার জন্য।
‘পরাণ’ এবং ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমা দেশের সত্য ঘটনাকে উপজীব্য করে তৈরি হয়েছে। যা পরিচালনা করেছেন রায়হান রাফী। দুটি সিনেমার নারী চরিত্রের বৈপরীত্যে উপস্থাপন করায় অনেক দর্শক ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। পরিচালকের কাছে এক নারী দর্শক আবদার করেছেন নারীশক্তিকে কেন্দ্র করে একটি সিনেমা উপহার দেওয়ার জন্য। এই বিষয়ে রায়হান রাফী ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গল্পের সামঞ্জস্যতার জন্য চরিত্রগুলো তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে নারীশক্তিকে কেন্দ্র সিনেমা তৈরির ইচ্ছা আছে।
সিনেমায় আফরান নিশো’র আসার খবরে অনেকে বলেছিলেন, দর্শক যাকে নাটকে ফ্রিতে দেখে অভ্যস্থ তাকে টাকা খরচ করে টিকেট কেটে কে দেখবে! শুরুতে মুখ থুবড়ে পড়বে তার সিনেমা, পাবে না কোন মার্কেট। ফলে ফ্লপের খাতায় নাম লিখিয়ে বিদায় নিতে হবে। বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রে হিট সিনেমা উপহার দেয়া রীতিমত সোনার হরিণ পাওয়ার মত।
কিন্তু শুরুর সমালোচকদের মুদ্রার উল্টা দেখতে হলো সিনেমা মুক্তির পর। আফরান নিশো’র অভিষেক যেন বাংলা সিনেমার নতুন জোয়ার এনে দিয়েছে। হল বিমুখ মানুষ দলে দলে সিনেমা হল আসছে। দীর্ঘদিন শীর্ষে থাকা ঢালিউডের কিং শাকিব খানের সিনেমা ‘প্রিয়তমা’র সঙ্গে একপ্রকার পাল্লা দিয়ে এখনও চলছে ‘সুরঙ্গ’। যা এদেশের পরিচালক-প্রযোজকদের আশান্বিত করছে।
শেষ করছি আফরান নিশোর কথা দিয়েই, ‘সিনেমা দর্শক গ্রহণ করবে সেটার বিষয়ে আমি আশাবাদী, তবে এভাবে গ্রহণ করবেন সেটা কল্পনাও করেননি।’
Posted ৮:৪৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ আগস্ট ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin