বুধবার ২২শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে অপরূপ সুন্দরের প্রতীক বক

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট ২০২৩ | প্রিন্ট

বাংলার ঐতিহ্যের সংস্কৃতির পাখি বক। নিজ ভুবনের আপন পাখি বকের এখন ক্রান্তিকাল। ধবধবে সাদার উপমায় বলা হয় বকের পালকের মতো সাদা।

বর্তমানে সবার পরিচিত নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক এ বড়বক বিপন্নের পথে। মানুষের খাদ্য ও অনুকূল পরিবেশের কারণে বড় সাদা বক আগের মতো দেখা যায় না। নান্দনিক এই পাখিটি এখন বিলুপ্তির পথে।

প্রকৃতিতে সবুজ অপরূপ সুন্দরের প্রতীক ফসলের মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বকের লুকোচুরি যেন চিরন্তন বাংলার এক নয়নাভিরাম রূপ। প্রকৃতিতে শুভ্রতা ছড়ানো পাখি বড় সাদা বক হারিয়ে যাচ্ছে। শীত ছাড়াও নানান সময়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বিভিন্ন হাওর, বিল ও জলাশয়ের ধারে দলবেঁধে নামতো দেশি সাদা বক।

আরো পড়ুন >>> ঘের পাড়ে সাম্মাম চাষে শিক্ষকের চমক

ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ধরলা নদীর পাড়ের বককে নিয়ে সেই করুণ গান বেধে ছিলেন ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে…’ । ঝাউগাছের মতো এক ধরনের ফাঁদ বানিয়ে তার ওপর একটি বন্দী বক রেখে দেয়। উড়ে আসা বক বন্দী বককে উদ্ধার করতে এসে নিজেই বন্দী হয়।

নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক এ বড়বক বিপন্নের পথে।

নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক এ বড়বক বিপন্নের পথে।
খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে বক পাখি নিজেই মানুষের খাবার টেবিলে যাচ্ছে। নিরীহ এই বক পাখির কাছে মানুষের শেখার আছে অনেক। বককুলের যে কোনো প্রজাতির বিপদে উড়ে এসে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে চতুর মানুষ।

বক পাখি কম বেশি সবারই পরিচিত। লম্বা পা বিশিষ্ট মিঠাপানির জলাশয় ও উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মৎস্যভোজী একদল জলচর পাখিকে বক বলা হয়।

আমাদের এলাকায় চার-পাঁচ প্রকার বক দেখা যায়। এসব বকের কিছু প্রজাতি আকৃতি ভেদে বগলা ও বগা নামে পরিচিত। ধূসর বক, লালচে বক, সাদা বক, গোবক, কোঁচ বক ও খুন্তে বকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

আরো পড়ুন >>> মায়ের হাত ধরে অদম্য প্রতিবন্ধী সিয়াম

বিভিন্ন জাতের বক সাধারণ চোখে দেখতে এক রকম মনে হলেও ভালো করে তাকালেই তাদের মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। ভেড়ামারা পদ্মা নদী ও হিসনা নদীর চরে এবং জিকে ক্যানালে এবং জিকে লেগে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াত বক। সারা দিন নদীর এ চর থেকে মাছ শিকার করে আহার করত তারা। এখন আর আগের মতো বক চোখে পড়ে না।

সাদা বক বাংলার অতি পরিচিত পাখি। প্রকৃতিতে শুভ্রতা ছড়ানো সাদা বক দল বেঁধে নিঃশব্দে চলে। দেখা মেলে খোলা হাওর কিংবা জলাশয়ে। কখনো পুকুর পাড়েও দেখা যায় এদের। কোথাও আবার ঘন বাঁশবনে দল বেঁধে বসে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। কখনো মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলা, কখনো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের সবুজ গালিচার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিত এই সাদা বক।

প্রকৃতিতে সবুজ অপরূপ সুন্দরের প্রতীক ফসলের মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বকের লুকোচুরি যেন চিরন্তন বাংলার এক নয়নাভিরাম রূপ।

প্রকৃতিতে সবুজ অপরূপ সুন্দরের প্রতীক ফসলের মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বকের লুকোচুরি যেন চিরন্তন বাংলার এক নয়নাভিরাম রূপ।
স্থানীয়রা জানান, বহু যুগ আগে আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখির আগমন শুরু হলে নদী বিল জলাশয়ে থাকা আমাদের বক অতিথি পাখিদের বরণ করে নিয়ে থাকবার জায়গা করে দিতো। নিকট অতীতে নদী বিলে ঝিলে বকদের সারি মন ভরিয়ে দিত। কখনো গাছের ওপরে উড়াউড়ি করে কখনো শাখায় বসে ক্লান্তি কাটিয়ে ফের উড়াল দিতো। চরে কানি বক, গো বক, মঝলা বগা, ধুপানি বকদের দেখা যায়। মওলার বিল, জুনিয়াদহর হাওড়, সোলেম নগর ঢাকা পাড়ার চর, চন্দনা নদীর পাড়ে বক পাখিদের ছিল নিরাপদ অভয়ারণ্য।

ফকিরাবাদ মাঠে কাজ করা কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, এই সাদা বক আমাদের অনেক উপকার করে। চারা ধানের জমিতে মাজরা পোকা ও ফড়িংসহ ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে থাকে। এছাড়া ক্ষেতে পানি দেওয়ার পর যেসব পোকা ভাসতে থাকে তা খেয়ে পরিষ্কার করে। এতে ফসলের উপকার হয়। কিন্তু এখন এই সাদা বক আগের মতো আর দেখা যায় না। শিকারীদের ফাঁদে পড়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে এই সাদা বক।

আরো পড়ুন >>> ১১ বছরে দুঃখ ঘুচলো গাইবান্ধাবাসীর

প্রকৃতির নিসর্গের এই দৃশ্য এখন চোখে পড়ে কালেভদ্রে। শীত বসন্তে বক পাখিরা কখনও দল বেঁধে উড়ে কখনও মাছ শিকারে ব্যস্ত থেকে নদী ও বিলকে সৌন্দর্যে ভরে দিতো। দিশেহারা হয়ে বককুল আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। জায়গা পাচ্ছে না। বৃষ্টি ঝরলে বক পাখি আশ্রয় নেয় গাছের শাখায়। খুঁজে বেড়ায় কাশবন, বাঁশ বাগান। বড় বৃক্ষ। এখন কাশ বনের কাঠি ব্যবহার হচ্ছে গৃহস্থালি উপকরণ বানানোর কাজে। বাঁশ বাগান কেটে সাফ। নগরায়নের অসামঞ্জস্য থাবায় গাছেরাও উধাও হয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারায় মনুষ্যকুলের সঙ্গে বককুলেরও ত্রাহী মধুসূদন অবস্থা।

বক পাখি বাংলাদেশে ১১ প্রজাতির বকের মধ্যে সাত প্রজাতি দেশি। এর মধ্যে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি চারটি। এগুলো বাঘা বক, রঙ্গিলা বক, নিশী বক ও কোদালি বক। অতীতে এই বকগুলো মানুষের বাসের মধ্যেই উড়ে বেড়াত। নদী ও বিলের তীরে যাদের বাড়ি তারা রাতে নিশী বকের ওয়াক ওয়াক ডাক শুনত। নিশী বক এমন ডাকে মাছ খুঁজে বেড়ায়। নিশী বক রেহাই পাচ্ছে না।

ভেড়ামারা উপজেলার চেয়ারম্যান হাজী আক্তারুজ্জামান মিঠু বলেন, আগে বিপুল পরিমাণ বক দেখা যেত। এরা দল বেঁধে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু অবৈধ শিকারসহ নানা কারণে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহিদুজ্জামান বলেন, শস্য ক্ষেতে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার ও বিভিন্ন বিল ভরাট এবং পানি না থাকার কারণে বক আজ বিলুপ্তির পথে।

ভেড়ামারা সরকারি মঞিরা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এক সময় উপজেলায় বিভিন্ন খাল বিল ও পুকুরে এবং কৃষি জমিতে প্রচুর বকের আনাগোনা ছিল। সন্ধ্যা হলেই পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠতো চারপাশ। তবে এখন সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।

রায়টা স্কুলের শিক্ষক সালাম বলেন, এক সময় ক্ষেত-খামারে কানি ও সাদা বক দেখা গেলেও এখন চোখে পড়ে না। মাঝে মধ্যে দু-একটা দেখা গেলেও শিকারিরা সেগুলো ধরে বিক্রি করে দেন।

এই বককে নিয়ে ছড়া ‘ওই দেখা যায় তাল গাছ ওই আমাদের গাঁ, ওইখানেতে বাস করে কানি বকের ছা…’ প্রবীণরা ছোট বেলায় পড়েছে। শিশুরা আজো খুব মজা করে পড়ে। ছেলেবেলায় দাদি নানিরা মজা করে বলতেন কানি বক কানা বকের গল্প ও ছড়া। নদী বিলের জলের গভীরে ও ডাঙ্গায় দূরের জিনিস দেখতে পায়। কোন কিছু হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার পর বকের চোখের উপমা দেয়া হয়।

বক বিপন্ন হচ্ছে জলাভূমি ব্যবহারে অসচেতনতা। রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাত্রা বেশি। দেশী বৃক্ষরোপণ কম ও বট পাকুরের গাছ কেটে ফেলা। বকের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া। এভাবে গত দশ বছরে উত্তরা-দক্ষিণাঞ্চলের নদ নদী, খাল বিল, পূর্বাঞ্চলের হাওড়, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এলাকা বকের সংখ্যা কমেছে।

বাংলাদেশে বকের আগমন ঠিক কবে হিসাব নেই। তবে মনে করা হয় ছয় ঋতুর বৈচিত্র্যের এই দেশে বক পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে শুরু করেছে লাখো বছর আগে। সেই হিসাবে বক বাংলাদেশের আপন ভুবনের পাখি।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ২:৪০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]