রবিবার ১২ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ট্রেনেই অপারেশন, এ যেন সিনেমার দৃশ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   মঙ্গলবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | প্রিন্ট

ট্রেনেই অপারেশন, এ যেন সিনেমার দৃশ্য

রাত বাজে ৮টা। তখন চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। হঠাৎ ট্রেনের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী জানতে পারলেন, গর্ভবতী এক নারী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে মাইকে জানালেন, ট্রেনের মধ্যে যদি কোনো ডাক্তার থাকেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ‘ঘ’ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মাইকিং শুনে একজন ডাক্তার এলেন। সঙ্গে দু’জন নার্সও দ্রুত ‘ঘ’ কোচে ছুটে এলেন। মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন চিকিৎসক, নার্সসহ একদল মানুষ।

ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়া ঐ নারীর পাশে দাঁড়ালেন হাতে হাত রেখে। আর তাতে ট্রেনের মধ্যেই সেই নারী অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং ট্রেনের মধ্যে রক্তপাত হয়ে তার গর্ভে থাকা চার মাসের নবজাতক মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ান ট্রেনের যাত্রীরা।

ঢাকা-চিলাহাটীগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে রোববার রাতে এ ঘটনা ঘটে। ট্রেনের মধ্যেই ঐ নারীর মৃত বাচ্চা প্রসব করান ট্রেনে থাকা চিকিৎসক ও নার্সরা। ট্রেনের কামরা হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার। এ যেন সিনেমার কাহিনীর বাস্তব চিত্র।

ঐ ট্রেনে দায়িত্বরত পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ট্রেনটি ঢাকা থেকে চিলাহাটী যাচ্ছিল। বরাবরের মতোই ট্রেনের পেছনের কোচ থেকে টিকিট চেকিং শুরু করি। সঙ্গে ছিলেন আরেক টিটিই বেলাল হোসেন। রাত ৮টা নাগাদ ট্রেনটি তখন গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। টিকিট চেক করতে ট্রেনের ‘জ’ নম্বর কোচে যাবার পর হঠাৎ করে শাহিন আলম নামের এক যাত্রী জানান ‘ঘ’ নম্বর কোচে একজন গর্ভবতী মহিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার পেছনে থাকা গার্ড সিফাত হোসেনকে জানাই দ্রুত পিএ অপারেটরকে ট্রেনের মাইকে একটা ঘোষণা করতে যে, ট্রেনের মধ্যে যদি কোন ডাক্তার থাকেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ‘ঘ’ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

মাইকিং করার পর একজন ডাক্তারকে (ঢাকার ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানাউল্লাহ) ‘জ’ কোচ থেকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। এরপর ‘চ’ কোচ থেকে ৫ম বর্ষের একজন শিক্ষানবিশ মহিলা ডাক্তারও (রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী ডা. আফসানা ইসলাম রোজা) আসলেন। মাইকিং শুনে দু’জন নার্সও দ্রুত ‘ঘ’ কোচে ছুটে গেলেন।

এরপর চিকিৎসক গর্ভবতী ঐ নারীর রক্তপাত দেখে জরুরিভাবে হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে ৯৯৯-এ কল দিলেন এক যাত্রী। সিদ্ধান্ত হলো টাঙ্গাইল স্টেশনে ট্রেন থামানো হবে। ভাগ্য সহায় হলো চিলাহাটি এক্সপ্রেসের ক্রচিং পড়েছে সেখানে। ৯৯৯ থেকে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর দেওয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সঙ্গে কথা হলো, তারাও রেডি।

এদিকে গর্ভবর্তী মহিলা যাত্রীর রক্তপাত যেন থামছেই না, গর্ভে থাকা চারমাসের নবজাতক গর্ভেই মারা গেল। মহিলা ডাক্তার, নার্সরা ঐ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ‘ঘ’ কোচের মহিলা যাত্রীরা নিজেদের কাছে থাকা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন পুরো জায়গাটা। তিন আসনের চেয়ারের সারিটা যেন সেই মুহূর্তে হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার।

পরে রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ ঐ নারী ও তার স্বামী দিনাজপুরের ফুলবাড়ি স্টেশনে নামেন। আর চিকিৎসক সানাউল্লাহ সারা রাত, সারাটা পথ ঐ রোগীর পাশে বসেছিলেন। চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করেন শিক্ষানবিস চিকিৎসক আফসানা ইসলাম রোজা, নার্স ফারজানা আক্তার, মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইন্ট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন নিশা, রুমি ইসলাম। এভাবেই একদল মানবিক মানুষের সহযোগিতায় বেঁচে যান একজন নারী।

টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, আমার চাকরি জীবনে ট্রেনের মধ্যে বেশকিছু মানবিক ঘটনা দেখেছি। তবে এই ঘটনাটি অভূতপূর্ব। ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যরা যেভাবে একজন অসুস্থ নারীর পাশে সহযোগিতা বাড়িয়ে দিলেন তা অনন্য। স্যালুট জানাই ঐসব মানবিক মানুষদের। জয় হোক মানবতার।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ২:০৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]