মঙ্গলবার ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পর পর ব্যাংক লুট: পাহাড় নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শুক্রবার, ০৫ এপ্রিল ২০২৪ | প্রিন্ট

পর পর ব্যাংক লুট: পাহাড় নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা হয়েছে। লুট করা হয় টাকা ও অস্ত্র। একইসঙ্গে অপহরণ করা হয় সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ম্যানেজার মো. নেজাম উদ্দিনকে। ফলে জেলাজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। এ ঘটনায় পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে (কেএনএফ) দায়ী করছে সরকার। বান্দরবানের ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছে কেএনএফ। বান্দরবান পুলিশ জানিয়েছে, হামলাকারীরা দুটি এসএমজি ও এর ৬০টি গুলি, ৮টি চীনা রাইফেল ও ৩২০টি গুলি, চারটি শটগান ও ৩৫টি কার্তুজ নিয়ে গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এই হামলা ও অপহরণের মধ্য দিয়ে যতটা না টাকা-অস্ত্র লুট করতে চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি নিজেদের অবস্থান ও সক্ষমতার জানান দিতে চেয়েছে। তাছাড়া পাহাড়ে এই হামলা সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে কেএনএফ। পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও নিজেদের আবার আলোচনায় আনতে পেরেছে তারা। যা হতে পারে নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।

এদিকে, এ হামলার আগাম তথ্য কারও কাছে না থাকাকে চরম গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। পাহাড়ে যাদের অপারেশনাল সক্ষমতা রয়েছে, তাদের হাতেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়ার দাবি উঠছে। পাহাড়ের নিরাপত্তা বিষয়ে এক্সপার্টরা বান্দরবানে জড়ো হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

অপরদিকে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় কেএনএফের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার।

বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) সন্ধ্যায় সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করে র‌্যাব। পুলিশ ও আনসারের লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানের কথা জানিয়েছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্চ ডিআইজি নুরে আলম মিনা।

জানা যায়, গত মঙ্গলবার রাতে রুমা শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে সোনালী ব্যাংকের শাখায় হামলা চালায় অস্ত্রধারী কেএনএফ সদস্যরা। মসজিদ থেকে রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে ধরে ব্যাংকে নিয়ে যায় তারা। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুসল্লিদের। ব্যাংক ম্যানেজারের মাধ্যমে ভল্টের টাকা নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ম্যানেজারের চতুরায় তা পারেনি অস্ত্রধারীরা। তবে ওই এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অস্ত্র নিয়ে যায় কেএনএফ সদস্যরা। সঙ্গে অপহরণ করে নেজাম উদ্দিনকে। পরদিন দুপুরে থানচিতে দুটি ব্যাংকের শাখায় হানা দিয়ে কয়েক লাখ টাকা লুটে নেয় তারা। হামলাকারীরা দুটি এসএমজি ও এর ৬০টি গুলি, ৮টি চীনা রাইফেল ও ৩২০টি গুলি, ৪টি শটগান ও ৩৫টি কার্তুজ নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বান্দরবান পুলিশ।

ব্যাংক লুটে জড়িতদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা দেখছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি। সব কিছুই করব, আগে সব কিছু জেনে নিচ্ছি। এর পেছনে কারা আছে, কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা কোনো পরিকল্পনা আছে কি না—এগুলো দেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। আমরা কোনো ছাড় দেব না। কঠিন ব্যবস্থা নেব।

এখানে ভূ-রাজনৈতিক কোনো ব্যাপার আছে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে এখনো এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। অনেক কিছুই হতে পারে কিন্তু না জেনে, তথ্য না পেয়ে আমরা বলতে পারছি না।

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে পরপর দুদিন ব্যাংকের হামলা, অস্ত্র-টাকা লুট ও ম্যানেজার অপহরণের পর কেএনএফের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা পরিষদের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা। এর আগে বুধবার শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি এক জরুরি সভা আহ্বান করে। সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত তুলে ধরার জন্য সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

২০২৩ সালের ২৯ মে কেএনএফের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েক দফা অনলাইনে ও দুই দফা সশরীর বৈঠক হয়েছে। গত বছরের ৫ নভেম্বর ও গত ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সশরীর দুই দফা বৈঠকে দুটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়। এতে তারা চাঁদাবাজি, অপহরণ ও লুটপাটসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতির পর তারা রুমা ও থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি করে। কমিটি মনে করে, তাদের অতিসাম্প্রতিক ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির শান্তি আলোচনা বৈঠকসহ সব ধরনের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কেএনএফের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠক করবে না।

২০২২ সালের জুন মাসে প্রথম আলোচনায় আসে কেএনএফ। তাদের হাতে রাঙামাটির বিলাইছড়িতে তিনজন নিহত হন। এরপর একের পর এক হত্যা, লুট, অপহরণে নাম আসে কেএনএফের। শুধু ২০২৩ সালেই ৬ সেনা সদস্যসহ ২০ জনের বেশি তাদের গুলিতে প্রাণ হারান। অপহরণের ঘটনা ঘটছিল নিয়মিত। এরই মধ্যে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে টাকার বিনিময়ে পার্বত্য এলাকায় আশ্রয়, অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের অভিযোগ ওঠে কেএনএফের বিরুদ্ধে। এই প্রশিক্ষণের জন্য তারা তিন বছর মেয়াদি চুক্তি করেছিল।

র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন বলেন, জঙ্গিরা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বিষয়টি জানার পর আমরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় অভিযান শুরু করি। ধারাবাহিক অভিযানে তাদের ট্রেনিং সেন্টার শনাক্ত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ শতাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ও কুকি-চিনের ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের অভিযানের ফলে অনেকটা কোণঠাসা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চলছিল। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কুকি-চিনের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো থাকলে এমনটা হতো না। নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। পুলিশ তো এই ধরনের এলাকায় নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিশেষায়িতভাবে প্রশিক্ষিত নয়। কুকি-চিনের উদ্ভব যেখানে হয়েছে, সেখানে দাঁড় করিয়ে দিলেই নিরাপত্তা হয় না। আমি নিজে ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছি। সেনাবাহিনীকে উঠিয়ে আনার পর পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া যাচ্ছে না। তারা যে বিষয়ে পারদর্শী, এটা সেই কাজ নয়। উপজেলা শহরে সন্ধ্যায় লাইট বন্ধ করে হামলা করেছে। তাহলে সেটা পুলিশ টের পায়নি কেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক থাকলে গোলাগুলি হতো, এত সহজে সন্ত্রাসীরা তাদের কাজ করে চলে যেতে পারত না।

পাহাড়ে নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী যখন মোতায়েন ছিল, তখন এসব এলাকায় সব সময় সেনাবাহিনী ও কমিউনিটি পেট্রোলিং থাকত। বহু বছর ওখানে থাকার কারণে আমরা গ্রাউন্ড থেকে তথ্য পেতাম। কার ছেলে কোথায় আছে, কী করছে, কার মুভমেন্ট সন্দেহজনক, সব তথ্য আমরা পেতাম। আমাদের গ্রাউন্ড লেভেলে স্ট্রং ইন্টেল ছিল। কেএনএফ এই হামলাকে নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। বান্দরবানের এই এলাকাগুলোতে সার্বক্ষণিক নজরদারি দরকার। সেজন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা দরকার বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য যা যা করার দরকার তাই সরকারকে করতে হবে। তারা যে রাস্তায় আসে, সেই রাস্তায় যায় না। ফলে সেভাবে প্রস্তুতি রাখা লাগবে। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই। আশপাশে কয়েকটি জায়গায় ক্যান্টনমেন্ট আছে। সেনাবাহিনী এই এলাকায় কাজ করে অভ্যস্ত। ফলে এখানে তাদের কাজ করা সহজ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, কেএনএফেএর নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাথান লনচও বম। তার বাড়ি রুমার ইডন বমপাড়া। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছাত্রাবস্থায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৯ সালের দিকে এই নাম পাল্টে করা হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট।

সংগঠনটি রাঙামাটি ও বান্দরবানের যে ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এরমধ্যে আছে বান্দরবানের রুমা, থানচি, লামা, রোয়াংছড়ি ও আলীকদম উপজেলা; রাঙামাটির সাজেক উপত্যকা, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলা। তাদের ঘোষিত রাজ্যে ৫ সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতে পারবে। তারা হলো- বম, খুমি, খিয়াং, পাংখোয়া ও লুসাই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পাহাড়ে এই পাঁচ সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। কেএনএফের সশস্ত্র সদস্য হাজারের বেশি।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৫ এপ্রিল ২০২৪

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]