মঙ্গলবার ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউসুফের ফাঁদ পাতা জালে আটকা মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৪ | প্রিন্ট

ইউসুফের ফাঁদ পাতা জালে আটকা মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে ও ব্যবসার কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে নরসিংদীর মনোহরদী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি ইউসুফ হাসানের বিরুদ্ধে। ইউসুফ গোতাশিয়া ইউপির দূর্বাকান্দী গ্রামের আব্দুল হেকিমের ছেলে।

তিনি ছোট থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। অভিযুক্ত ইউসুফের ফাঁদ পাতা জালে আটকা পড়ে মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্সের বিদ্যালয়ের কাজ স্থবির অবস্থায় রয়েছে।

জানা গেছে, ইউসুফ হাসান নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার নামে এবং ব্যবসার কথা বলে প্রায় দেড় শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রতারণার অভিযোগে নরসিংদীসহ বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে।

মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও মালামাল উদ্ধারের জন্য মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

লিখিত অভিযোগ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৯ সালে চুলা গ্রামের তোতা মিয়া, খোকা মিয়া ও তাদের তিন বোন মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স এবং প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার নামে ১১৩ শতাংশ জমি দান করেন। পরবর্তীতে দুটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ইউসুফ হাসান। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে চাকরির দেওয়ার নামে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা গ্রহণ করেন। এমনকি অন্যান্য জেলায় প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার কথা বলেও লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ব্যবসার কথা বলে এবং ধার হিসেবে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। টাকা ফেরত চাইলে মামলা-হামলার ভয় দেখানো হয় পাওনাদারদের।

তাছাড়া বিদ্যালয়ের এক আয়ার সঙ্গে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকায় এলাকার লোকজন তাকে আটক করেন। পরবর্তীতে ওই নারীকে নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকা ছাড়া।

বিদ্যালয়ের জমিদাতা তোতা মিয়া বলেন, ইউসুফ একজন প্রতারক এবং চরিত্রহীন। আমার নিকটাত্মীয় কয়েকজনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন লোকজনকে চাকরি দেবে বলে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। প্রায়ই ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে এসে বিচার দাবি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা জানান, ইউসুফ হাসান কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও রংপুর জেলায় প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের নামে শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে দুই-তিন লাখ টাকা করে নিয়েছেন। পরবর্তীতে কাজ না হওয়ায় টাকা ফেরত নিতে প্রায়ই তাদেরকে এলাকায় আসতে দেখা গেছে।

চুলা গ্রামের আব্দুল কাইয়ূম বলেন, আমাকে মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্সে শিক্ষক পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন ইউসুফ। তিন বছর আগে টাকা নিলেও চাকরি হয়নি। এমনকি আমার টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না।

মনোহরদী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সদস্য মার্জিয়া বলেন, আমি নিজে একজন প্রতিবন্ধী ২০০৯ সালে ইউসুফ হাসানের সঙ্গে পরিচয় আমার। তার সংস্থায় সদস্য হয়েছি ২০ হাজার টাকা দিয়ে। পরে ওই সংস্থার অধীনে বিদ্যালয় করা হবে, ওই বিদ্যালয়ে আমাকে শিক্ষক রাখবে বলে ধাপে ধাপে আমার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন ইউসুফ। দেই দিচ্ছি বলে এখনো টাকা পাইনি। প্রায় এক বছর ধরে তিনি উধাও হয়ে গেছেন।

আরেক সদস্য ফখরুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়েকে চাকরি দেবে বলে দুই লাখ টাকা নিয়েছেন ইউসুফ হাসান। চাকরিও হয়নি আমার টাকাও ফেরত দিচ্ছে না তিনি। তবে অভিযুক্ত ইউসুফ বলেন, টাকা দিয়েছেন অন্যের কাছে, আমার কাছে না।

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার আব্দুর রহমান বলেন, আমি কুমিল্লা প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্সের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। আমাদের বিদ্যালয়ের সভাপতি লোকমান হোসেন ভূঁঞার সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় প্রায়ই আমাদের বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতেন ইউসুফ হাসান। এ সুবাদে আমার সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে উঠে। ২০২২ সালে তার বিদ্যালয় সরকারিকরণের জন্য জরুরি টাকা দরকার বলে আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা ধার চায়। আমি বিভিন্ন তারিখে তাকে চার লাখ টাকা দেই। ১৫ দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো টাকা দেয়নি। এ ঘটনায় মনোহরদী থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, ইউসুফ বাল্যকাল থেকেই অনেকটা প্রতারক চরিত্রের লোক। তিনি বিভিন্ন সময় ইন্সুরেন্স কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে অনেক প্রতিবেশীর টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ধর্মীয় লেবাস দেখে অনেকেই খুব সহজে তার প্রতারণায় পা ফেলে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

মনোহরদী প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্সের প্রধান শিক্ষক ইকবাল হোসাইন বলেন, ইউসুফ হাসান প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স এবং প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার কয়েক মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক কর্মচারী ও জমিদাতাদের দাবির প্রেক্ষিতে মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বরাবরে দুটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। ইউসুফ হাসান বিদ্যালয়ে ব্যবহৃত ১ টি মোটরসাইকেলসহ করোনা কালীন সময়ে ৩ টি ৪৫ ইঞ্চি টেলিভিশন, ২ টি ফ্রিজসহ মূল্যবান সরঞ্জামাদি সংরক্ষণের অজুহাতে বাড়িতে নিয়ে যান। পরবর্তীতে আর ফেরত দেননি।

তাছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীদের কাছ থেকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ধার হিসেবে লাখ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন। সেগুলোও ফেরত দেননি।

অভিযুক্ত ইউসুফ হাসান বলেন, আমি কারো টাকা আত্মসাৎ করিনি, মানুষেরা মনগড়া অভিযোগ করেছেন । অনেকে বিদ্যালয়ে টাকা দিয়েছে তা ঠিক আছে। কিন্তু তা বিভিন্ন মারফতে খরচ করতে দিয়েছি। তাদের দেয়া মানি রিসিট ও পর্যাপ্ত প্রমাণ আমার কাছে আছে।

তিনি আরো বলেন, কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার আব্দুর রহমানের কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা ধার এনেছি আবার পরিশোধ করে দিয়েছি। তার ব্যাংক রিসিট আমার কাছে আছে। পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা মিথ্যা অভিযোগ। এছাড়া অভিযোগ করা মার্জিয়া নামে প্রতিবন্ধী নারী আমার সংস্থার সদস্য হওয়ার জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। দেড় লাখ টাকা দেয়নি। সবাই আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ ও মামলা দিয়েছে। আমিও আদালতের দারস্ত হয়েছি।

মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাছিবা খান বলেন, ইউসুফ হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মনোহরদী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন বলেন, সরেজমিন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হয়েছে।

নরসিংদী জেলা সমাজসেবা অফিসের উপপরিচালক মাসুদুল হাসান তাপসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিং এ থাকায় কথা বলা যায়নি।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৪

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]