বৃহস্পতিবার ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেয়ের হত্যাকারীদের ধরতে এক মায়ের অভিযান, থ্রিলারের থেকে কম নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | প্রিন্ট

মেয়েকে অপহরণের পর প্রায় দুই বছর পরে লাশের খোঁজ পেয়েছিলেন মরিয়ম। তারপর আরো এক বছর কেটে যায়।মেয়েদের খুনিদের তিনি ছাড়বেন না বলে, ছদ্মবেশ ধরেন। এই মায়ের নাম মরিয়ম এলিজাবেথ রডরিগেজ মার্টিনেজ। শেষ পর্যন্ত ১০ জন দুষ্কৃতী ধরা পড়ে। কিন্তু সত্যানুসন্ধানের মাশুল মা দিয়েছিলেন তার জীবন দিয়ে। নিজের বাড়ির সামনেই ১২টি বুলেট বিদ্ধ করেছিল তাকে।

ঘটনাটি ঘটেছিল মেক্সিকোতে। এই সত্যি ঘটনা থেকেই পরে ২০০৮ সালে তৈরি হয়েছিল ফরাসি-আমেরিকান উদ্যোগে ছবি ‘টেকন’। যার কেন্দ্রীয় উপজীব্য ছিল মরিয়ম এলিজাবেথ রডরিগেজ মার্টিনেজের সংগ্রাম।

মরিয়ম ছিলেন মেক্সিকোর সান ফার্নান্দোর বাসিন্দা। অভিযোগ, তার মেয়ে ২০ বছর বয়সি ক্যারেনকে অপহরণ করা হয়েছিল ২০১২ সালে। সে বছর ২৩ জানুয়ারি উত্তর পূর্ব মেক্সিকোর ট্যামৌলিপাস শহরের রাজপথে অপহরণ করা হয়। কুখ্যাত অপরাধ গোষ্ঠী লস জেটা কার্টেলের দুষ্কৃতীদের নাম এই কাণ্ডে উঠে আসে। অভিযোগ, তারা চলন্ত গাড়িতে করে অপহরণ করে নিয়ে যায় ক্যারেনকে। এরপর কয়েক হাজার ডলার মুক্তিপণ চাওয়া হয়।

অপহৃতার পরিবারের দাবি, দুষ্কৃতীদের চাহিদামতো মুক্তিপণ মেটানোর পরেও তার ফিরে পাননি মেয়েকে। পরিবর্তে দুই বছর পরে ক্যারেনের মৃতদেহ পাওয়া যায় পরিত্যক্ত জায়গায়। মেয়ের হত্যা মেনে নিতে পারেননি মরিয়ম। দেশের আইন ব্যবস্থার অপেক্ষায় না থেকে নিজেই ময়দানে নামেন অপরাধীদের খুঁজে বার করতে। ঠিক করলেন যেখান থেকে হোক, যে ভাবেই হোক দুষ্কৃতীদের খুঁজে বার করবেনই।

অনেক রকম ছদ্মবেশ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল নকল বন্দুক এবং পরিচয়। তিনি ধীরে ধীরে খুঁজে বার করলেন লস জেটাস কার্টেলের সদস্যদের। তাদের খোঁজে পাড়ি দিয়েছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকার টেক্সাস শহরেও। মরিয়মের মূল নিশানা ছিল অল্পবয়সি এক ফ্লোরিস্ট। মরিয়ম জানতে পেরেছিলেন দুষ্কৃতী চক্রে যোগ দেওয়ার আগে সে রাস্তায় ফুল বিক্রি করত।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চর মারফত খবর পেয়ে মরিয়ম তাকে চিহ্নিত করে মেক্সিকো আমেরিকা সীমান্তে। সেখানে সে রোদচশমা বিক্রি করছিল। মরিয়ম পরে জানিয়েছিলেন, তাকে দেখ চিনতে পেরে গিয়েছিল ওই দুষ্কৃতী। কিন্তু পালাতে পারেনি তার হাত থেকে। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছানো পর্যন্ত একঘন্টা তার দিকে নকল বন্দুক তাক করে পাহারা দিয়েছিলেন মরিয়ম। প্রাণভয়ে পালাতে পারেনি সেই দুষ্কৃতী।

মরিয়মের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১০ জন দুষ্কৃতীকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে ক্রিস্টিয়ান গঞ্জালেজ নামে এক জনের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। একটা সময়ে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চক্রের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে দীর্ঘ কথা চালিয়ে যেতেন মরিয়ম। সে ভাবেই ‘সামা’ বলে এক জনের নাম জানতে পারেন মরিয়ম।

এরপর অনলাইনে চিরুনি তল্লাশি করে সামা-র খোঁজ পান মরিয়ম। জানতে পারেন তার বাড়ি থেকে গাড়িতে ২ ঘণ্টার দূরত্বে একটি আইসক্রিমের দোকানের নারী কর্মীর সঙ্গে সামার সখ্যের কথা। সেই দোকানে দিনের পর দিন গিয়ে অবশেষে একদিন সামার দেখা পান মরিয়ম। তার পিছু নিয়ে চিনে ফেলেন বাড়িও। কিন্তু যত দিনে পুলিশে তার গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরি করল, তত দিনে সামা পগারপার।

এরপর সামাকে আবিষ্কার করেন মরিয়মের ছেলে লুইস। ঘটনাচক্রে লুইসের দোকানেই টুপি পছন্দ করতে এসেছিল সামা। এ বার আর গ্রেফতারি এড়াতে পারেনি সে। সামাকে জেরা করে বাকি দুষ্কৃতীদের খোঁজ পায় পুলিশ। মেয়ের হত্যাকারীদের হাজতে পাঠাতে পেরে শান্তি পান মরিয়ম।

মরিয়ম জানতেন তিনি নিজেও অপরাধীদের নিশানা হয়ে গিয়েছেন। তার পরেও পিছিয়ে আসেননি। স্থানীয় এক পুলিশ অফিসার তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ সাহায্য নেননি। তবে নানা ভাবে মরিয়মের পাশে ছিলেন সেই অফিসার। ২০১৭ সালে মাদার্স ডে-তে নিজের বাড়ির সামনে ১২বার গুলিবিদ্ধ হন মরিয়ম। রক্তাক্ত অবস্থায় মরিয়মকে রাস্তার ধারে দেখতে পান তাঁর স্বামী। নিথর মরিয়মের ডান হাত ঢোকানো ছিল তাঁর পার্সে। হাতের পাশেই ছিল নকল পিস্তল। চেষ্টা করেও আত্মরক্ষা করতে পারেননি।

সরকারের দরজায় দরজায় সাহায্যের জন্য ঘুরেছিলেন মরিয়ম। কিন্তু সকলে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই তিনি নিজেই লড়াইয়ে নেমেছিলেন নারী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। মেক্সিকোয় প্রতি বছর অনেকে অপহৃত হন। পরে তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। মরিয়ম একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি করেছিলেন। সেখানে শামিল ৬০০টি পরিবার। যাঁদের কোনও না কোনো নিকটজন অপহৃত হয়েছেন।

সরকার ও প্রশাসনের সাহায্যের বাইরে তারা নিজেরাই চেষ্টা করে চলেছেন হারানো নিকটজনকে খুঁজে পাওয়ার। মরিয়মের অবর্তমানে এখন স‌ংস্থার প্রধান তার ছেলে, লুইস। দুঃসাহসিক অভিযানে মরিয়মের হাতিয়ার ছিল ছদ্মবেশ। নিজের চুলের রং পরিবর্তন করতে ঘন ঘন। এক সময় কাজ করতেন স্বাস্থ্য বিভাগে। সেখানকার পুরনো ইউনিফর্ম পরে স্বাস্থ্যকর্মী সেজে ঘুরে বেড়াতেন পথে পথে। একমাত্র মেয়ের হত্যাকারীদের সন্ধানে।

সূত্র: আনন্দবাজার

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]