শনিবার ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৫০ বছরে বিনা পারিশ্রমিকে খুঁড়েছেন ৫০০ কবর

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট

৫০ বছরে বিনা পারিশ্রমিকে খুঁড়েছেন ৫০০ কবর

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটিয়ালপুর গ্রামের বাসিন্দা আলী হোসেন ঢালী। তিনি সুলতান ঢালীর ছেলে। তার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। দুই স্ত্রীর কবর নিজের হাতেই করেছেন। বর খোঁড়াই যেন তার নেশা। ৫০ বছরে এখন পর্যন্ত খুঁড়ছেন ৫০০ কবর। কবর খুঁড়ে কারও থেকে কোনো টাকা নেন না তিনি।

জানা যায়, চাঁদপুর সদরের দাসাদি গ্রাম, ফরিদগঞ্জ উপজেলার চাঁদপুর গ্রাম, ভটিয়ালপুর, প্রত্যাশী, চিরকা গ্রাম, ধানুয়া, চির কুমরিয়া, চর দুঃখিয়া, গাব্দেরগাঁও, নয়ার হাট, চর ভাগল গ্রামসহ জেলার বিভিন্নস্থানে মৃত ব্যক্তির কবর খুঁড়েছেন।

আলী হোসেন জানান, আমার বাবা কবর খোঁড়ার কাজ করতেন। তার মৃত্যুর পর আমি কবর খোঁড়ার কাজ শুরু করি। তখন ১৫-১৭ বছরের যুবক ছিলাম। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ কবর খোঁড়ার কাজ করেছি। বাবার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এই কাজ করি। করোনাকালে সবাই ভয়ে মরদেহ থেকে দূরে চলে যেত। তখন আমি করোনা আক্রান্তসহ নানা রোগে মৃতদের কবর দিয়েছি।

আমার টাকা-পয়সার কোনো লোভ নেই। কবর খুঁড়ে কারো কাছ থেকে হাদিয়া বা টাকা পয়সা নেই না। এমনকি অনুষ্ঠানেও খেতে যাই না। মৃত ব্যক্তির কবর খোঁড়া নেশা হয়ে গেছে। আমি গরিব মানুষ। শুধু ঘরের ভিটা আছে। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। দুই স্ত্রীর কবর দিয়েছি। আল্লাহ যদি দেয় আখিরাতে কিছু পাব। কোনো কবর তৈরি করতে গিয়ে পুরানো কঙ্কাল পেলে ওই কবরে জায়গা করে গুঁজে রাখি। আমি সরকারি কোনো অনুদান পাই না।

আলী হোসেনের পুত্রবধূ আমেনা বেগম জানান, আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ১২ বছর। এ পর্যন্ত দেখে আসছি, তিনি মৃত ব্যক্তির কবর খোঁড়ার কাজ করেন। আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে দাদা, খালুসহ অনেক আত্মীয়-স্বজনের কবর তৈরি করেছেন।

আলীর চাচাতো ভাই বৃদ্ধ লোকমান ঢালি জানান, আমার চাচা আগে কবর খোঁড়ার কাজ করতেন। তার মৃত্যুর পর চাচাতো ভাই কবর খোঁড়ার কাজ করেন। সে কারো কাছ থেকে এক টাকাও নেয় না। মৃত ব্যক্তির পরিবারের থেকে এক গ্লাস পানিও খায় না।

স্থানীয় মিলন জানান, ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, তিনি কবর তৈরি করেন। কবর তৈরি করার কাজে কোনো হাদিয়া নেন না। মানুষ মারা গেলে কবর তৈরি করেন। তাকে সরকারি বয়স্ক ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা দিলে এভাবে বৃদ্ধ বয়সে মানুষের সেবা করতে পারবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, আলী হোসেন কবর খোঁড়ে। আমার স্বামীর কবর তৈরি করেছেন। এখন প্রায় ৫০০ কবর তৈরি করেছেন। বিনিময়ে কারো থেকে কিছু নেন না। এক বেলা ভাতও খায় না। তিনি খুব ভালো মানুষ। তার তুলনা হয় না। কবর তৈরির কারণে এলাকার অনেকে তাকে চেনে। তাকে সরকারি বয়স্ক ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা দিলে সে বৃদ্ধ বয়সেও মানুষের সেবা করতে পারবে।

ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন টিটু বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখেছি আলী অনেক মানুষের কবর খুঁড়ে দেন। তিনি সাধারণ এক কৃষক-শ্রমিক। বিনিময়ে কোনো টাকা নেয় না। এরকম মানুষ সমাজে খুব কম পাওয়া যায়। একজন দিনমজুর হয়েও পরোপকারী মানুষ হিসেবে ভূমিকা রাখছেন।

কাউন্সিলর বলেন, হতদরিদ্র এমন পরোপকারী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার। তিনি আমার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করেননি। তিনি যোগাযোগ করলে তাকে বয়স্কভাতার ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করব।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান তসলিম বেপারী জানান, আলী হোসেনকে প্রায় ৩০ বছর আগে থেকে চিনি। তখন থেকে আমি দেখেছি, মানুষ মারা গেলে কাজ রেখে কবর তৈরির জন্য চলে যেতেন। মানুষের মৃত্যু খবর শুনলেই সঙ্গে সঙ্গে কবর দিতে চলে যান। অসহায় এই পরোপকারী মানুষটিকে সরকারি বয়স্ক ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা দিলে তিনি বৃদ্ধ বয়সেও মানুষের সেবা করতে পারবেন।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]