শুক্রবার ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আইএমএফের ঋণ যেভাবে ভাসিয়ে রেখেছে ডুবুডুবু মিশরকে

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট

আইএমএফের ঋণ যেভাবে ভাসিয়ে রেখেছে ডুবুডুবু মিশরকে

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবানন দেউলিয়া হয়ে গেছে। লেবাননের মতোই দেউলিয়া হওয়ার পথে এ অঞ্চলের আরেক দেশ মিশর। গত কয়েক বছর ধরেই দেশটির অর্থনীতি ডুবুডুবু। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেয়া ঋণের জোরে কোনো রকমে নিজের নাকটা ভাসিয়ে রেখেছে দেশটি।

প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত মিশরের জন্য তিনটি বেলআউট করেছে আইএমএফ। দেশটি বর্তমানে আর্জেন্টিনার পর আইএমএফের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও পাহাড়সমান ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের সঙ্গে মিশরের ঋণ চুক্তিগুলো হয়েছে। ২০১২ সালে এর বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো। সেখান থেকে বেড়ে ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫৫ বিলিয়ন ডলারে।

ঋণ ছাড়াও আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে মিশর। এছাড়া গত এক দশকে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে আনুমানিক ৯২ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে দেশটি। সিসি ক্ষমতায় আসার পর দুবছর মিশর উপসাগরীয় দেশগুলোর ডিপোজিট বা আমানত রাখতে শুরু করে, যা দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভকে শক্তিশালী করে তোলে। কিন্তু সেই সহায়তা ২০১৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। ফলে মিশর তার ঋণ পরিশোধ করতে ও আমদানিনির্ভর অর্থনীতিকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে শুরু করে।

একটা উন্নয়নশীল দেশ বেশি বেশি ঋণ নিচ্ছে; আর সেই ঋণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রকল্পে ব্যয় হওয়ার পরিবর্তে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেই শেষ হচ্ছে। মিশরের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটছে। যেমনটা বলছেন কায়রো ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক আলিয়া আল-মাহদি। সম্প্রতি মিডল ইস্ট আইকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত ছিল এসব প্রকল্পে বরাদ্দ করা যা রাজস্ব আয় বাড়াতে পারে। কিন্তু তা না করে অবকাঠামোগত প্রকল্পে বেশি বেশি ব্যয় করা হয়েছে, যা আর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। যার ফলে আমরা এখন ভুগছি।’

মিশরের অর্থনৈতিক দুর্দশা

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে মিশর। কিন্তু সম্প্রতি সেই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী, ডলারের বিপরীতে মিশরীয় পাউন্ডের দাম হ্রাসের সঙ্গে যোগ হয়েছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে হাঁসফাঁস অবস্থা সাধারণ মানুষের।

আর তাই মিশরজুড়ে আলোচনার মূলে রয়েছে অর্থনীতির চরম দুর্দশা। ইকোনমিস্ট বলেছে, মিশরের দর্শনীয় নানা প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেসব ধ্বংসাবশেষের তালিকায় এখন যোগ হয়েছে এর অর্থনীতি। মিসরীয় পাউন্ড গত বছর অর্ধেক মূল্য হারিয়েছে এবং চলতি বছর বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মুদ্রার স্থান পেয়েছে।

মিশরের রাজস্বের প্রায় অর্ধেক এখন যায় ঋণ পরিশোধে, যা জিডিপির ৯০ শতাংশের সমান। সরকারি হিসাবে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি এখন ২১ শতাংশ। তবে বাস্তব জীবনযাত্রার ব্যয় আরও অনেক বেশি। বিশেষভাবে খাবারের দাম অস্বাভাবিক দ্রুত বাড়ছে। কায়রোবাসীরা বলছেন, ‘আমরা এখন কেনাকাটা করতে গিয়ে তিন কেজির পরিবর্তে, এক কেজি বা আধা কেজি কিনতে বাধ্য হই।’

অর্থনৈতিক সংকটের নেপথ্যে

সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিশরের অর্থনৈতিক দুর্দশার মিল খুব কমই পাওয়া যায়। দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ দৈনিক দুই ডলারও খরচ করার সামর্থ্য রাখে না। মিশরের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও সরকারি অব্যবস্থাপনা। এর সঙ্গে সম্প্রতি বাহ্যিক সংকট হিসেবে যোগ হয় করোনা মহামারি, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ ও সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দার হুমকি।

প্রেসিডেন্ট সিসির নেতৃত্বে ২০১৪ সাল থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম চালকবিহীন মনোরেলসহ জাতীয় ‘মেগা-প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কথা প্রচার করে আসছে মিশর। আর ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কায়রোর কাছে নতুন প্রশাসনিক রাজধানী শহর তৈরি করছে। এগুলো দেশে কৃত্রিমভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। অনেক প্রকল্পে সেনাবাহিনীর বিশাল অর্থ উপার্জনের ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ককে যুক্ত করা হয়েছে।

এই জাতীয় নীতিগুলো মিশরের রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতকে অনুৎসাহিত করে ও বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে। পরিণামে দেশের অর্থনীতিকে বিদেশি ঋণের ওপর আরও নির্ভরশীল করে তোলে। এভাবে মিশরের বিদেশি পাওনা ১৫৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। আর জাতীয় আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সেই বিদেশি ঋণের দায় শোধে চলে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ রাবাহ আরেজকি গত ১৮ জানুয়ারি এক প্রবন্ধে লিখেছেন, এই সব কারণ একসঙ্গে সম্প্রতি মিশরকে একটি খাদের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। পরিস্থিতি এমন যে অর্থনৈতিক সংকটে মিশর আরেক লেবানন হওয়ার দিকে এগোচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন অনেকেরই।

লেবাননের লক্ষণ মিশরে

গত বছরের এপ্রিলে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, লেবানন ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। লেবাননের অনেক আলামত এখন মিশরে দেখা দিতে শুরু করেছে। খাদ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে, বেতন অর্ধেক হয়েছে। আর ব্যাংকগুলো টাকা উত্তোলন সীমিত করে দিয়েছে। এখন লেবানিজদের মতো একই সমস্যার মুখে মিশরীয়রা। তবে ১০ কোটির বেশি মানুষের দেশে যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, তাহলে ফলাফল ভয়ংকর হতে পারে।

লেবাননে হতাশ স্থানীয়রা কেবল তাদের নিজের সঞ্চয় তুলে নেয়ার জন্য ব্যাংক লুট পর্যন্ত চলে গেছে। শহরগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর মতো জ্বালানি নেই। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ঋণের চক্রে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মিশরে পরিস্থিতি এখনও ততদূর যায়নি।

কিন্তু কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করছে, মিশর কি শিগগিরই ‘নতুন লেবানন’ হয়ে উঠবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে তুলনা করা যায় না। তবে মিশর ও লেবাননের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মিশরের দারিদ্র্যের হার লেবাননের কাছাকাছি। দেশটিতে এখন অন্তত ৬০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমায় বা এর কাছাকাছি বাস করছে।

আইএমএফের ঋণ

গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মিশরের জন্য ৩-বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করে। এটি ২০১৬ সাল থেকে আইএমএফের সঙ্গে দেশের তৃতীয় এ ধরনের ব্যবস্থা। এই ঋণ মিশরকে বিদেশ থেকে আরও বিনিয়োগের পাশাপাশি আরও আর্থিক সহায়তা আকর্ষণ করতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে। চুক্তিটি সম্পন্ন করতে মিশরীয় সরকারকে আইএমএফের কাছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দিতে হয়েছে।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৩:০৭ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]