নিজস্ব প্রতিবেদক | শনিবার, ২৭ মে ২০২৩ | প্রিন্ট
বলা হয় প্রচারেই প্রসার। আর তাই ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সব সময় মুখিয়ে থাকে। তারা বেশি পরিমাণে ওষুধ বিক্রির জন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে অনেক চুক্তিও করে। হাসপাতালে আসা রোগীদের চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ওষুধ চিকিৎসকরা পেসক্রিপশনে (ব্যবস্থাপত্রে) লেখেন কিনা সেটিও থাকে নজরদারিতে। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের রিপ্রেজেন্টেটিভদের (বিক্রয় প্রতিনিধি) একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হাসপাতালে হাসপাতালে দাপিয়ে বেড়ান রিপ্রেজেন্টেটিভরা।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিন দেখা যায়- রোগীরা ডাক্তার দেখিয়ে বের হলেই তাদের কাছে থাকা পেসক্রিপশনের ছবি তুলতে রিপ্রেজেন্টেটিভরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে তারা জোর করে রোগীদের থেকে পেসক্রিপশন নিয়ে ছবি তোলা শুরু করেন। এতে রোগীদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। মূলত ৫৮ ভাগ রিপ্রেজেন্টেটিভ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকদের দ্বারা নিজ নিজ কোম্পানির ওষুধ লেখাতে চাপ প্রয়োগ করে থাকেন।
জানা গেছে, ব্যবস্থাপত্রে লেখার মাধ্যমে ওষুধের বিক্রি বাড়াতে অনেক চিকিৎকের পেছনে কোম্পানিগুলো লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে থাকে। চিকিৎকদের গাড়ি-বাড়ি পর্যন্ত উপঢৌকন দেওয়া হয়। আবার চিকিৎসকদের পেছনে কোম্পানিগুলো যে অর্থ খরচ করে, সেটা ওষুধের দামের সঙ্গেই যুক্ত করে দেয়। এতে অনায়াসে বেড়ে যায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ব্যয়। বিষয়টি জনজীবনে অনেক ক্ষেত্রে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আয়ের ২৭ ভাগেরও বেশি ব্যয় হয় তাদের বিপুল-সংখ্যক কর্মীদের পেছনে।
সরেজমিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের গেটে দেখা যায় শত শত মোটরসাইকেলের জটলা। রিপ্রেজেন্টেটিভরা রোগীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। ডাক্তারের চেম্বার থেকে রোগীরা কখন বের হবেন সেই আশায়।
গত বুধবার দুপুর ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, রামপুরার বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম ডাক্তার দেখিয়ে বের হন। তখনই তাকে ঘিরে ধরেন রিপ্রেজেন্টেটিভরা। মুহূর্তের মধ্যেই তার হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটি নিয়ে মোবাইলে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কেউ প্রেসক্রিপশন দেখছেন, কেউ অন্যজনের মাথার উপর দিয়ে মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা করছেন।
বিষয়টি জানতে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে কয়েকজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে কথা হলে তারা ডেইলি বাংলাদেশকে জানান, কোম্পানিভেদে তাদের প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ জন রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার টার্গেট থাকে। অনেক সময় অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলতে হয়।
তারা আরো জানান, চিকিৎসকরা রোগীর প্রেসক্রিপশনে তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কিনা, তা দেখতে হয়। ছবি তুলে নিয়ে পরে বসদের (সিনিয়রদের) কাছে রিপোর্ট করতে হয়।
তারা বলেন, চিকিৎসকেরা নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখছেন কিনা তার ওপর ভিত্তি করেই ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করা হয়। এর ওপরেই অনেকটাই কোম্পানির লাভ-লস নির্ভর করে।
রোগী সিরাজুল ইসলাম জানান, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন তিনি। প্রতি মাসে এর পেছনে গুনতে হচ্ছে আট থেকে ১০ হাজার টাকা। আবার দফায় দফায় ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা চালিয়ে নেয়াও এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, শুনেছি কোম্পানিগুলো মাসোহারা হিসেবে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে চিকিৎসকদের পেছনে। অথচ এসব মাসোহারার পরিমাণ কমিয়েওতো ওষুধের দাম কম রাখা যেতো।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেলের বহিঃর্বিভাগ গেটে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দেখা যায়। এখানেও তারা রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা রাজি হননি।
মাদারীপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা আব্দুস সাত্তার ডেইলি বাংলাদেশকে জানান, ডাক্তার দেখিয়ে বের হতেই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাকে ঘিরে ধরেন। এরপর তারা হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটি নিয়ে মোবাইলে ছবি তোলা শুরু করেন।
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কৌশিক মল্লিক ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, একজন চিকিৎসক রোগীর জন্য নিজের পছন্দের ওষুধ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ফলে যেসব চিকিৎসকের সঙ্গে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির চুক্তি আছে, তারা সেই চুক্তি অনুযায়ী ওষুধ লিখে থাকেন। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে ওষুধের জেনেরিক (শ্রেণিগত) নাম দিয়ে প্রেসক্রিপশন দেওয়ার সিস্টেম চালু করতে হবে। রোগী তখন বাইরের দেশের মতো সরাসরি জেনেরিক ওষুধ কিনবেন। তখন কোম্পানি চয়েজে ওষুধ প্রেসক্রাইব করার কোনো অপশন চিকিৎসকের কাছে থাকবে না।
চিকিৎসক নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রিপ্রেজেন্টেটিভ আর কিছু অসাধু চিকিৎসকের বেআইনি কর্মকাণ্ডের কারণে চিকিৎসার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে নজরদারি বাড়ানো দরকার।
বাংলাদেশি মার্কিন চিকিৎসক ডা. রুমি আহমেদ খান বলেন, আমাদের হেলথ সেক্টরে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে পলিফার্মেসি অর্থাৎ ডাক্তারদের অতিরিক্ত ওষুধ প্রেসক্রাইব করার প্রবণতা। যা পুরোপুরি ওষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের কন্ট্রোলে।
তিনি বলেন, একটা রোগী পেলেই বিশেষ করে বয়স্ক/ক্রনিক রোগীদের ক্ষেত্রে ১০-৩০টা ওষুধের পলিফার্মেসি প্রেসক্রিপশন হয়ে যায়। এতে রোগীর সিরিয়াস শারীরিক ক্ষতিই শুধু হচ্ছে না, চিকিৎসাসেবার ব্যয়ও ১০ গুণ বেড়ে যাচ্ছে। যা হচ্ছে, এর সবকিছুই সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভদের প্ররোচনা, নানামুখী প্রলোভন ও চাপের কারণে হচ্ছে।
অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, চিকিৎসা নিয়মিত ফলোআপ না করা এবং ওষুধ একবার কাজ না করলে অন্য চিকিৎসকের কাছে চলে যাওয়া। এর ফলে রোগীর জন্য এক-একটা ওষুধের থেরাপিউটিক ট্রায়ালের কোনো সুযোগ থাকে না। এতে ডাক্তারের মাথায় যে ধরনের ওষুধ আসে এবং তার কাছে যে কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ বেশি আসে, তাদের ওষুধই ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন।
ওষুধ কোম্পানিগুলোর এমন অ্যাগ্রেসিভ সেলস ক্যাম্পেইন এখনই কন্ট্রোলের পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। তিনি আরো বলেন, তাদের রেগুলেশনের (প্রবিধান) আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে একটা মোরাটোরিয়াম (আইন প্রয়োগপূর্বক স্থগিত রাখা) জরুরি দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে- ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ব্যয় বেড়ে যায়। এর ফলে ১৬ শতাংশ রোগী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেয়া ৯৭ শতাংশ রোগীই সেখানে ওষুধ পান না। তারা বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে সেই ওষুধ কিনে থাকেন। একইভাবে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। ফলে সহজেই রোগীর ব্যয় বেড়ে যায়। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় নিঃস্ব হচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা ওষুধ কোম্পানিগুলো তৈরি করেছে, চিকিৎসকরা করেননি।
তিনি বলেন, ১১৭টি নির্ধারিত ওষুধের দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে হুটহাট করে ওষুধ কোম্পানিগুলো মূলবৃদ্ধি করতে পারে না। অন্যদিকে এর বাইরে থাকা ওষুধগুলোর দাম কোম্পানি নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের একটা কমিটি সেই দাম ভেরিফিকেশন করে। ঐ কমিটিতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিও থাকেন। কোম্পানিগুলো যে দামের প্রস্তাবনা দেয়, সেখানে খুব বেশি নড়চড় হয় না। কারণ, কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের পেছনে ব্যয়ের টাকা বাড়তি দামের মাধ্যমে সমন্বয় করে নেয়। এতে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ব্যয়ে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হয় ১৬ শতাংশ রোগী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এ অবস্থা থেকে বের হতে করণীয় কী- এমন প্রশ্নে ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বাজারে যত ধরনের ওষুধ আছে, সব ওষুধের দাম ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। তা বাস্তবায়নের পর প্রয়োজনে ফর্মুলা রিভাইজ করা যেতে পারে।
সৈয়দ আব্দুল হামিদ আরো বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। আমরা বারবার বলছি- ঔষধ প্রশাসনকে এফডিএ’র (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) আদলে একটি শক্তিশালী কমিশন করা দরকার। যেটা থাকবে স্বাধীন। এতে মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। ফলে প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
Posted ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৭ মে ২০২৩
ajkerograbani.com | Salah Uddin