বুধবার ২২শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কক্সবাজারে এক বছরের উন্নয়ন পরিক্রমা

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | প্রিন্ট

২০২৩ সালের পুরো বছরজুড়ে নানাভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কক্সবাজার। সরকারের সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার ৭২টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের মধ্য দিয়ে বদলে গেছে এ জেলার চিত্র। জেলার এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। পাশাপাশি পাল্টে গেছে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা।

২০২৩ সালে কক্সবাজারের উন্নয়নের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল রেললাইন প্রকল্প। এর মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়েছে সমুদ্রনগরী কক্সবাজারের মানুষ।

চলতি বছরের (১১ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন ও নান্দনিক আইকনিক রেলস্টেশন।

এছাড়া এদিন প্রধানমন্ত্রী আরো বেশকিছু প্রকল্প উদ্বোধন করেন। রেললাইন প্রকল্পে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা, মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর চ্যানেলে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। একইদিন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় প্রায় ৬৮ কোটি টাকার অন্য ৪টি প্রকল্প। সবমিলিয়ে ৮৮ হাজার কোটি টাকার ২০টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১১ নভেম্বর রেললাইন ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী যে প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করেছেন সেগুলো হচ্ছে- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মিত মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযুক্তি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটে ৫৯৫ মিটার পিসি বক্স গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, কক্সবাজার সদরের খাল লাইনিং অ্যাপ্রোচ রোড ও ব্রিজ। এছাড়াও আছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ৪টি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৪টি, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ও জেলা প্রশাসনের দুটি ছাদখোলা বাস।

সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর অন্যতম মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি জাপানের আর্থিক সহায়তায় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম।

১২০০ মেগা ওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয় গত ২৯ জুলাই দুপুরে। তখন ৬ মেগাওয়াটের পরীক্ষামূলক উৎপাদনের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এটি ১২ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু করে অক্টোবরের শুরুতে।

উৎপাদিত এ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। মহেশখালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের মাঝামাঝি ১ হাজার ৬০৮ একর জমির ওপর স্থাপিত হচ্ছে দুটি ইউনিটে বিভক্ত এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিএল) বাস্তবায়ন করছে প্রকল্পটি।

প্রকল্পের নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৪ সালে অনুমোদন পাওয়া মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে এটি করা হয় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এতে আগে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) দেওেয়ার কথা ছিল ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। এবার সেই ঋণ বাড়িয়ে জাইকা মোট ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা দেয়। আর প্রকল্পটিতে সরকারি তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হয় ৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা।

এছাড়াও ঐদিন প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ২৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা কক্সবাজার সদরের খাল লাইনিং অ্যাপ্রোচ রোড ও ব্রিজ এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ৪টি প্রকল্প। যেখানে রয়েছে ৪ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল ঠান্ডা চৌকিদার পাড়ার ৬০ মিটার সিসি গর্ডার ব্রিজ, ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চকরিয়া বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ প্রকল্প, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, আর সাড়ে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে গোরকঘাটা সড়ক প্রস্তুতকরণ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প ৪টির মধ্যে রয়েছে- ৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে কক্সবাজার সদরের জাহারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, সাড়ে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে মহেশখালীর ইউনুসখালি নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উখিয়ার রত্নাপালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও মারিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রায় সাড়ে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রামু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধন করা হয়।

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ৬৭ কোটি টাকার টেকনাফ মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার রিসিলেন্ট শেল্টার কাম আইসোলেশন সেন্টার, রামুর নন্দাখালী ১৮৪ মিটার আর্চ আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ প্রকল্প এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস ফর ট্যুরিস্ট।

স্বাধীনতার ৫২ বছরে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় গত ১৩ এপ্রিল। আগের দিন ১২ এপ্রিল রাত থেকে দ্বীপটির দেড় হাজার গ্রাহক পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ সুবিধা পেতে শুরু করে।

প্রকল্পটির পরিচালক ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, দ্বীপটিতে ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে সন্ধ্যাকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। ঐ দেড় হাজার গ্রাহককে প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দেওয়া চালু করা হয়। আবেদন করা ২০ হাজার গ্রাহককে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্পটির মেয়াদকাল ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই দ্বীপটিতে পৌঁছে গেছে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ।

প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, প্রকল্পের অধীনে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে কুতুবদিয়া। বিদ্যুৎ নিতে সাগরতলে দুই লেনে গেছে দীর্ঘ ৬ কিলোমিটার ক্যাবল। ওখানে ১২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন উপকেন্দ্র, ৭২০ কিলোমিটার সঞ্চালন বিতরণ স্থাপন হয়েছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কস্তুরাঘাট সংলগ্ন বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ‘কক্সবাজার-খুরুশকুল’ সংযোগ সেতু। দীর্ঘ ‘প্রিস্টেইট বক্স গার্বার সেতু’। দীর্ঘ ৫৯৬ মিটারের এ সেতুর জন্য ব্যয় হয় ২৫৯ কোটি টাকা। সেতুটির আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের গত ১ সেপ্টেম্বর। শেষ হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন খান বলেন, ‘কক্সবাজার জেলা সারা বিশ্বের কাছে পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত। শহরের উত্তর পাশে বাঁকখালী নদী প্রবহমান। এ নদীর পাড়ে যে জায়গাটার মধ্যে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটা এর আগে পরিণত হয়েছিল ময়লার ভাগাড়ে। সেই জায়গায় এখন একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে। এ সেতুটি নির্মাণের ফলে যে বিষয়টা নতুন মাত্রা যোগ করেছে সেটি হলো পর্যটন শিল্প। এছাড়া এর আরেকটা দিক থেকে কক্সবাজার শহরকে সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে এ সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

কক্সবাজার- ২ এর সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী ও সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া এখন উন্নয়নের মহাসড়কে উন্নীত হয়েছে। সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ায় লক্ষাধিক মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি সাগরের তলদেশ দিয়ে বিদ্যুৎতায়ন, এতে দ্বীপের মানুষের ৫৩ বছরের স্বপ্ন পূরণ হলো।

কক্সবাজার-৩ এর সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল জানান, এই সরকার কক্সবাজারের বহুমুখী উন্নয়ন করেছে। এরমধ্যে অন্যতম রেললাইন প্রকল্প। এই রেললাইনের মাধ্যমে কক্সবাজারের সঙ্গে দেশের রাজধানী ও অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় কক্সবাজারের পর্যটনের প্রসারের পাশাপাশি মৎস্য, চিংড়ি ও লবণ পরিবহনের পথ সুগম হয়েছে।

এছাড়াও ২০২৩ সালে কক্সবাজারের আরেকটি আলোচিত ঘটনা হলো, ঈদগাঁও নতুন উপজেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]