শনিবার ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৬২ বার মঞ্চায়ন ‘যশোর রোড’

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট

৬২ বার মঞ্চায়ন ‘যশোর রোড’

নরসিংদী জেলা প্রশাসনের হাতে গড়া সুবিধাবিঞ্চত শিশুদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাঁধনহারা’। সংগঠনটি এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্ত করে সাড়া জাগিয়েছে দেশজুড়ে। এর মধ্যে অন্যতম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘যশোর রোড’।

এছাড়াও সরকারের উন্নয়ধর্মী কার্যক্রম নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে একটি নাটক, সামাজিক অবক্ষয়রোধে করণীয় র্শীষক সচেতনতামূলক নাটক আলোর পথযাত্রী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘সামান্য ক্ষতি’ নাট্যরুপ দিয়ে দর্শকদের মন কাড়ে। হাটি হাটি পা পা করে সংগঠনটি ১১ বছর পার করেছে ২৬ মার্চ রোববার। এ উপলক্ষে বাঁধনহারা সংগঠনের নিজস্ব উদ্যোগে সংক্ষিপ্তভাবে পালন করা হয় বর্ষপূর্তি। এছাড়া একটি কেক কেটে জন্মদিন পালন তারা।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎতকালীন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজমের হাত ধরেই সংগঠনটির জন্ম। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সামনের দিকে কিছু সুবিধাবিঞ্চত ছেলে-মেয়ে বসা দেখতে পান। কিন্তু কর্মকর্তারা তাদের তাড়িয়ে দেন। তা দেখে তার মন খারাপ হয়ে যায়।

ওই সময় মঞ্চে উঠে ঘোষণা দেন, আজ যে ছেলে-মেয়েদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের দিয়েই একদিন এই মঞ্চে অনুষ্ঠান হবে। যেই কথা সেই কাজ। ওদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতে পরিকল্পনা শুরু করেন। সঙ্গে প্রশাসনের কয়েকজন ও বাইরে থেকে কয়েকজন সংস্কৃতিমনা লোকদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেন বাঁধনহারার। ২৬ মার্চ ডেটলাইন। তিনি তার লোকদের নিয়ে ছেলে-মেয়েদের খুঁজে বেড়াতে থাকেন। কর্মশালার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এরই মধ্যে ৩০০ জন শিশু কিশোর হাজির করা হয়।

ফেব্রুয়ারির শেষদিকে নরসিংদী জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ৫-১৪ বছরের ৩০০ জন ছেলে-মেয়ে হাজির। কেউ দিন মজুরের ছেলে, কেউ ট্রাকচালকের, কেউবা দোকানির সন্তান। কারোর আবার মা নেই কিংবা বাবা নেই। তাদের থেকে বাছাই করা হয় প্রায় ৮০ জন শিশু-কিশোর।

৯ মার্চ থেকে শুরু হয় কর্মশালা। সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে কর্মশালা। ছেলেমেয়েদের হাতে-কলমে অভিনয়, নাচ, গান, থিয়েটার, পাপেট ও মডেলিং শেখানো শুরু হয়। জেলা প্রশাসক নিয়মিত তাদের খোঁজ খবর নিতেন এবং মাঝে মধ্যে উপস্থিত হয়ে উৎসাহ দিতেন। তারা মেধাবী হওয়া সত্বেও দারিদ্র ওদের বিকাশের সুযোগ দেয়নি। প্রশিক্ষণ শেষে টিকে গেলো ৭০ জনের মতো শিশু-কিশোর। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয় তাদের দিয়েই।

২৫ মার্চ কালোরাত। ৭০ জন শিশু-কিশোর। হাতে মোমবাতি। ডিসি অফিস প্রাঙ্গণের স্মৃতিসৌধে জড়ো হয়েছিল। সে রাতে ওরাও আলোর পথযাত্রী গিয়েছিল। পরের দিন ২৬ মার্চ জেলা শিল্পকলা একাডেমির হলরুমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

এ অনুষ্ঠানে নাচ, গান ছাড়া তারা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক ‘যশোর রোড’ পরিবেশন করে তারা। নাটকটি দেখার পর দর্শকরা চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। এই অনুষ্ঠান দিয়েই মূলত আত্মপ্রকাশ করে ‘বাঁধনহারা নামে সাংস্কৃতিক সংগঠনটির। তারপর ১৬ ডিসেম্বর ২০১২। জেলা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিশাল মঞ্চে টানা পাঁচ দিন নাচ, গান, পাপেট শো, কোরিওগ্রাফি, মডেলিং, নাটক পরিবেশন করে তাক লাগিয়ে দেয় বাঁধনহারা সংগঠনটি।

অল্পদিনের মধ্যেই তাদের পরিবেশনায় খুশি হয়ে এগিয়ে আসে নরসিংদীর কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের কাজের সুবিধার্থে একটি থিয়েটার ভবন গড়ে দেন তারা। এ ভবনেই রিহার্সাল ও দাফতরিক কাজকর্ম পরিচালতি হয়। পরবর্তীতে তাদের জন্য একটি মাইক্রোবাস ও স্টুডিও থিয়েটার নির্মিত হয়।

২০১৪ সালে জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজম পদোন্নতি পেয়ে নরসিংদী ছাড়েন। নরসিংদীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে আগমন করেন আবু হেনা মোরশেদ জামান। একদিন বাঁধরহারা সংগঠনের কথা শুনলেন-জানলেন। তিনিও সংগঠনটিকে এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতি দেন।

শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ নিয়ে নাট্য ভাবনা ও নির্মাণ নিয়ে কাজ শুরু করেন জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান। জেলা প্রশাসক কন্ঠ দিয়ে নাট্যরুপ দেন এই নাটকটির।

তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান সংগঠনটির ভবিষ্যত অবস্থান শক্ত করতে গিয়ে আয়ের পথ খোলে দেন। তৈরি করেন বাঁধনহারা ফুডস নামে একটি রেস্তোরাঁ।

পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বাঁধনহারার হাল ধরেন। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সংগঠনটিকে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় সামাজিক অবক্ষয় ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধমূলক নাটিকা আলোর পথযাত্রী নামে একটি নাটক বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৭৫ বার প্রদর্শণ করা হয়।

বর্তমানে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান।
বাঁধনহারার আরোকিছু প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে, হায়েনার হাসি, কাঁঠালগাছের আত্মকথা, এক টুকরো খোলা চিঠি (বাল্যবিবাহ বিরোধী), খোকা, মাদক, ব্রিটিশ ৭১, আমার স্বাধীনতা, আমার বন্ধু গাছ, খাদক, জাদুর তুলি, মজার স্কুল, হ-য-ব-র-ল, সংগ্রাম ও মুক্তি, এসিড, ৫২’র চেতনা, না বলা গল্প, স্বর্ণজাল, ঘুমুর, ব্রিহন্নতা, ব্রিটিশ থেকে ৭১, স্বাধীনতা, ৩২ নম্বর মেঘ মহল, বাঁধনহারার রাজ্য, লাল গরু, অবাক জলপান (পাপেট শো), ভাষা ও বাঙালি জাগোসহ প্রায় শতাধিক নাটক মঞ্চায়ন করেছে।

বর্তমানে সংগঠনটিতে ৫০ জনের মতো সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে মূখ্য প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কামরুজ্জামান তাপু। সমন্বকারী ঝুমন সরকারকে সহযোগিতা করেছেন শাহিন ও রিশাদ।

এই ৫০জন সদস্যদের জন্য সংগীতের প্রশিক্ষক হিসেবে চিত্রা বিশ্বাস, নৃত্যে মাহফুজা আক্তার মুক্তা ও তবলার প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নিতাই সাহা। সপ্তাহে ক্লাস হয় তিন দিন। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার। প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত এবং বৃহস্পতিবার ও শনিবার বিকেল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত।

সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার এই ১১ বছরে নিতু, তোড়া, পলি, ঐশি, ঝিনুক, শান্তা, শিমলা, শিশির ও মেরাজ তাদের নৈপুন্য দেখাচ্ছেন দেশ বিদেশে। তাদের এই সংগঠন সম্পর্কে এর মধ্যে রবীন্দ্র ভারতীসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন অবগত হয়েছেন।

আগামী দিনে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ, সংগঠনটিকে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ, রেডিও বাঁধনহারা নামে একটি কমিউনিটি রেডিও এবং একটি অনলাইন টিভি চালু করার স্বপ্ন দেখছে বাঁধনহারা।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]