রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বাহনে পরিণত হয়েছে জীবন রক্ষার বাহন অ্যাম্বুল্যান্স

দয়াল কুমার বড়ুয়া   |   রবিবার, ০৯ জুলাই ২০২৩ | প্রিন্ট

প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বাহনে পরিণত হয়েছে জীবন রক্ষার বাহন অ্যাম্বুল্যান্স

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী আনা-নেওয়ার জন্য যত অ্যাম্বুল্যান্স প্রয়োজন তার তুলনায় আছে অনেক কম। এসব অ্যাম্বুল্যান্সের বেশির ভাগই নষ্ট থাকে বা নষ্ট করে রাখা হয়। আর এই সুযোগটি নেয় অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীদের বাধ্য হয়েই এই সিন্ডিকেটের বাণিজ্যিক সেবা নিতে হয়।

এসব অ্যাম্বুল্যান্সের বেশির ভাগই আবার রাস্তায় চলাচলের উপযোগী নয়। দূরপাল্লার ভাড়ায় গিয়ে অনেক অ্যাম্বুল্যান্স নষ্ট হয়। তখন রোগী ও তার স্বজনদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আবার অদক্ষ চালক দিয়ে চালানো হয় এসব অ্যাম্বুল্যান্স।

দুই সপ্তাহ আগে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ফরিদপুর অংশে দুর্ঘটনায় পড়ে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে আগুন ধরে যায়। ঘটনাস্থলেই আগুনে পুড়ে পরিবারের ছয় সদস্যের মৃত্যু হয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানাচ্ছে, প্রতিবছর যে পরিমাণ ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ছে তার চেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় পড়ছে অ্যাম্বুল্যান্স। রোগীর জরুরি সেবার কাজে ব্যবহৃত হলেও অ্যাম্বুল্যান্স একটি বাণিজ্যিক পরিবহন।

অথচ এই বাণিজ্যিক পরিবহনটির জন্য আলাদা নীতিমালা নেই। সড়ক পরিবহন বিধিমালায় অ্যাম্বুল্যান্সের কোনো সংজ্ঞা নেই। অনেকে মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুল্যান্স বানিয়ে নিচ্ছে। বিআরটিএর প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে নিবন্ধিত অ্যাম্বুল্যান্স আছে আট হাজার ২৮৭টি। বিআরটিএর নিবন্ধন ছাড়া চলছে চার হাজার ২১৩টি অ্যাম্বুল্যান্স।

ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুল্যান্স মালিক সমবায় সমিতির তথ্য মতে, বিভিন্ন সমিতির আওতায় দেশে প্রায় ১০ হাজার বৈধ অ্যাম্বুল্যান্স চলাচল করছে। এর বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন আরো প্রায় দুই হাজার ৫০০টি অ্যাম্বুল্যান্স চলাচল করছে।

অ্যাম্বুল্যান্সে বিকল্প চালকের সংখ্যা কম। কাজের নির্দিষ্ট কোনো শিডিউল নেই। সময়সীমা ছাড়াই চালকরা অ্যাম্বুল্যান্স চালাতে থাকেন। অ্যাম্বুল্যান্সচালকদের জন্য বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি টানা গাড়ি চালানো যাবে না, এটা গবেষণায় প্রমাণিত। কিন্তু আমাদের দেশে চালকের কর্মঘণ্টা মানা হচ্ছে না।

জীবন রক্ষার বাহন অ্যাম্বুল্যান্স প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বাহনে পরিণত হয়েছে। অ্যাম্বুল্যান্স এখন জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই বড় বড় দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে এই বাহন। অ্যাম্বুল্যান্সের দুর্ঘটনা কমাতে হলে নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অ্যাম্বুল্যান্সের নীতিমালা করা উচিত। অনেক অ্যাম্বুল্যান্সচালকের লাইসেন্সও নেই। আমরা আশা করব, অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য একটি নীতিমালা করা হবে। চালকদের দেওয়া হবে বিশেষ প্রশিক্ষণ।

এদিকে, ঈদুল আজহার ছুটিতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৫৪৪ জন। ৮ জুলাই সকালে নগরীর বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ২২ জুন থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ৬ জুলাই পর্যন্ত ১৫ দিনে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত এবং ৫৪৪ জন আহত হয়েছেন। বিগত ২০২২ সালের ঈদুল আজহায় যাতায়াতের সঙ্গে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৩৩ দশমিক ১১ শতাংশ, আহত ৪২ দশমিক ২৭ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া এই সময়ে রেলপথে ২৫টি ঘটনায় ২৫ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে ১০টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত, আহত ১৫ জন ও ৬ জন নিখোঁজ হয়েছেন।

বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত দুর্ঘটনার শীর্ষে মোটরসাইকেলের অবস্থান থাকলেও এবারের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পশুবাহী যানবাহনের ব্যাপক চলাচল ও ঈদযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবাধ চলাচলের কারণে এবার ঈদে দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান। এবারের ঈদে ৮৮টি ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনায় ৯৩ জন নিহত এবং ১৯৩ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, নিহতের ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ এবং আহতের ৩৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রায়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ৯১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৪ জন নিহত ও ৭৭ জন আহত হন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ, মোট নিহতের ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, মোট আহতের ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ।

এ সময় সড়কে দুর্ঘটনায় ৮২ জন চালক, ৯ জন পরিবহন শ্রমিক, ৩৫ জন পথচারী, ৪৭ জন নারী, ২৫ জন শিশু, ১৭ জন শিক্ষার্থী, ৫ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (১ পুলিশ, ১ নৌ বাহিনী, ১ র‌্যাব, ১ বিজিবি, ১ সেনাবাহিনী), ৪ জন শিক্ষক, ৫ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নিহত হন এবং তাদের পরিচয় মিলেছে।

দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশ মোটরসাইকেল, .০৫ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ ব্যাটারিচালিতরিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল, ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাস, ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা ও ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশা এসব দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল।

সড়কে দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতঃপূর্বে পেশাদার চালকদের লাইসেন্স পেতে ও নবায়নের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা ছাড়াও তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১১১টি সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দাখিল এবং দ্রুত ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির পথ সুগম করা হলে তা দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যেভাবেই হোক, সড়ক-মহসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সচেতন হতে হবে পথচারীদেরও। একই সঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে মনে করি আমরা।

লেখক: দয়াল কুমার বড়ুয়া, কলামিস্ট ও জাতীয় পার্টি নেতা, সভাপতি, চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরা। সংসদ সদস্য প্রার্থী ঢাকা-১৮ আসন।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৫:১০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৯ জুলাই ২০২৩

ajkerograbani.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিজয়ের ছড়া
(219 বার পঠিত)
advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদক ও প্রকাশক
মুহা: সালাহউদ্দিন মিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়

২ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। সম্পাদক কর্তৃক তুহিন প্রেস, ২১৯/২ ফকিরাপুল (১ম গলি), মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

ফোন : ০১৯১৪৭৫৩৮৬৮

E-mail: [email protected]